ইউজিসি’র ৪৬তম বার্ষিক প্রতিবেদনে পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে গুচ্ছ ভর্তি সহ ২৪ দফা সুপারিশ


শিক্ষা সংবাদ প্রকাশের সময় : ডিসেম্বর ২৮, ২০২০, ৮:৫২ অপরাহ্ণ / ৩২৪
ইউজিসি’র ৪৬তম বার্ষিক প্রতিবেদনে পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে গুচ্ছ ভর্তি সহ ২৪ দফা সুপারিশ
0Shares
উচ্চশিক্ষায় ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমাতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা চালু করতে চায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। সংস্থাটি দেশের নানা প্রান্ত থেকে ঢাকায় বেসরকারি উচ্চশিক্ষা নিতে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের জন্য একটি সমন্বিত বা গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষা চালু করতে সরকারের কাছে একটি নীতিমালা প্রণয়নের সুপারিশ করেছে।
পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সুশাসন ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ যুগোপযোগী করার সুপারিশ করেছে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালনার তদারকি সংস্থা ইউজিসি তাদের ৪৬তম বার্ষিক প্রতিবেদনে বেসরকারি উচ্চশিক্ষা নিয়ে এমন প্রস্তাব করে।
এর বাইরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধে অভিন্ন নীতিমালা প্রণয়নের সুপারিশ করে ইউজিসি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে তৃতীয় লিঙ্গের জন্য কোটা সংরক্ষণ, উচ্চশিক্ষায় গবেষণা নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির জন্য নীতিমালা প্রণয়ন, গবষণার চৌর্যবৃত্তি বন্ধে নীতিমালা তৈরি, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক কর্মকারী নিয়োগ-পদোন্নতির জন্য অভিন্ন নীতিমালাসহ উচ্চশিক্ষায় সংকট ও সম্ভবনা নিয়ে ২৪ দফা সুপারিশ করে সংস্থাটি। এসব সুপারিশ সংবলিত বার্ষিক প্রতিবেদন গত রোববার দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছে হস্তান্তর করে ইউজিসির একটি প্রতিনিধিদল। এ দলের নেতৃত্ব দেন ইউজিসির চেয়ারম্যান।
প্রসঙ্গত, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য শিক্ষার্থীদের দেশের নানা প্রান্তে দৌড়াতে হয়। এমনকি বর্তমানে দেশের শতাধিক প্রাইভেট ভার্সিটিতেও সেরা ২০টিতেও ভর্তি প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। সেখানেও ভর্তির জন্য শিক্ষার্থীদের হয়রানির শিকার হতে হয়। এতে শিক্ষার্থীরে পাশাপাশি অভিভাবকরা শারীরিক-মানসিকভাবে ভোগান্তিতে পড়েন। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সরকারের দীর্ঘ প্রচেষ্টার ফলে এবারই প্রথম দেশের ১৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা চালু করা হচ্ছে।
এর আগে গত বছর থেকে কৃষি ও কৃষির প্রাধান্য থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অভিন্ন প্রশ্নপত্রে একটিমাত্র পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হচ্ছে। তবে এখনও স্বায়ত্তশাসন খর্বের দোহাই দিয়ে বড় কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় আলাদা পরীক্ষা নেয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে।  ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীরা শুধু ভোগান্তিতে পড়েন না। প্রচুর অর্থও ব্যয় করতে হয়। বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) এক গবেষণায়ও উঠে এসেছে। গবেষণায় বলা হয়, প্রতি ভর্তি মৌসুমে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেয়া, ভর্তি কোচিংসহ আনুষঙ্গিক খাতে একজন শিক্ষার্থীর গড়ে ৯৬ হাজার টাকা খরচ হয়। অনেক দরিদ্র শিক্ষার্থীর পক্ষে এ অর্থ ব্যয় করা সম্ভব হয় না।
৪৬তম বার্ষিক প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুল্লাহ বলেন, বার্ষিক প্রতিবেদনে উচ্চশিক্ষার বর্তমান অবস্থা, সমস্যা ও করণীয় সম্পর্কে কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে-পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগে অভিন্ন নীতিমালা করা। যেটি প্রতিবেদনে ইতিমধ্যে আমরা সুপারিশ করেছি। তার নানা সুপারিশগুলোর ব্যাপারে সে আমরা পদক্ষেপ নেবো। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মধ্যে কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয় সরকারি বিধি বিধানকে অমান্য করছে। এ কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্থিক ক্ষেত্রে  স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে একটি অভিন্ন আর্থিক নীতিমালা করতে হবে। সাক্ষাৎকালে রাষ্ট্রপতিও  কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন বলে ইউজিসি চেয়ারম্যান জানিয়েছেন। সেগুলো নিয়ে দ্রুত কাজে হাত দেবে ইউজিসি।
জানা গেছে, দেশের সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ২০১৯ সালের কার্যক্রমের ওপর এ প্রতিবেদন তৈরি করা  হয়। ৫৬৮ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে ২৪টি সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে ৪৬টি সরকারি ও ১০৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য স্থান পেয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৭৩ সালে রাষ্ট্রপতির ১০ নম্বর আদেশ দ্বারা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইউজিসি প্রতিষ্ঠান করেন। মাত্র ছয়টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে দেশে পাবলিক ও বেসরকারি মিলে ১৫১ বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তদারকি করতে যে আইনি ক্ষমতা দরকার তা বিদ্যমান আইনে সম্ভব না। একই সঙ্গে উচ্চশিক্ষার পরিধি ও ব্যাপ্তি বৃদ্ধি পাওয়ায় ইউজিসির বর্তমান অবকাঠামো ও জনবল দিয়ে সামগ্রিক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে তদারকি করা সম্ভব হচ্ছে না। উচ্চ শিক্ষার সার্বিক ব্যবস্থাপনা এবং মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা নিশ্চিত করতে আর্থিক বরাদ্দ ও অবকাঠামো সুযোগ সুবিধাসহ আইনি ক্ষমতা বৃদ্ধি জরুরি বলে সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বেসরসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সুশাসন নিশ্চিত করতে আইন-২০১০ যুযোপযোগী করাসহ শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের উপযুক্ত বেতন কাঠামো ও চাকরি বিধিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। শতকরা তিন ভাগ মুুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও অসচ্ছল দরিদ্র পরিবারের মেধাবী শিক্ষর্থীদের বিনা বেতনে অধ্যায়ন সুযোগ নিশ্চিত করতে একটি সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়ন, বিদেশী শিক্ষার্থীদের ভর্তির ক্ষেত্রে নীতিমালা করে করেও আওতাভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে। একই জেলায় একাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দেয়া বন্ধের সুপারিশ করেছে ইউজিসি।
প্রতিবেদন মতে, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে আন্তজার্তিক পর্যায়ের শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহের নিবিড় ও কার্যকরী যোগাযোগ ও সহযোগিতা আশাব্যঞ্জক নয়। উচ্চশিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নের জন্য বিশ্বের প্রথম সারির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে যৌথ গবেষণা ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমে শিক্ষক, গবেষক ও শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের উৎকর্ষ সাধনে উচ্চতার ডিগ্রি অর্জনের জন্য স্কলারশিপ ও ফেলোশিপের সংখ্যা বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে। এজন্য একটি নীতিমালা করার মত দিয়েছে সংস্থাটি।
ইউজিসি তাদের প্রতিবেদনে বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে শিল্প, পেশাগত সংস্থা ও কমিউনিটির সংযোগ এবং শিল্প সংস্থার প্রতিনিধিদের কারিকুলাম কমিটিতে যুক্ত করে একাডেমিক প্রোগ্রাম যুযোপযোগী করা অতীব জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসম্মত শিক্ষক তৈরি করতে ইউনিভার্সিটি টিচার্স ট্রেনিং একাডেমি, উন্নত গবেষণা করার জন্য সেন্ট্রাল রিসার্চ ল্যাবরেটরি ও গবেষণার প্রয়োজনীয় ক্ষেত্র চিহ্নত করার জন্য ন্যাশনার রিসার্চ কাউন্সিল স্থাপন জরুরি। ইউজিসির অধীনে এ তিনটি প্রতিষ্ঠান স্থাপনের সুপারিশ করা হয়েছে। গবেষণার চৌর্যবৃত্তি ঠেকাতে কোন নীতিমালা নেই। গবেষণার মান নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির জন্য সফটওয়ার তৈরির সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভিন্ন ভিন্ন আইনের মাধ্যমে পরিচালিত হওয়ায় নানা জটিলতা তৈরি হচ্ছে। যে কারণে ৭৩ অধ্যাদেশ/আইনে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছাড়া অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে একটি ‘আ অ্যাক্ট’ এর মাধ্যমে পরিচালনার সুপারিশ করা হয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি/পদোন্নয়নের জন্য ন্যূনতম যোগ্যতা নির্ধারণী নীতিমালা দ্রুত বাস্তবায়নের সুপারিশ করে বলা হয়েছে, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ, পদোন্নতি/পদোন্নয়নের জন্য একটি অভিন্ন নীতিমালা ইউজিসি উদ্যোগ নিতে পারে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সান্ধ্যকালীন, উইকেন্ড, এক্সিকিউটিভ এ ধরনের কোর্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করছে। যে কারণে এসব কোর্চ বন্ধের সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া দ্রুত অ্যাক্রিডিটেশণ কাউন্সিল আন্তজার্তিম মান অনুসরণ করে সকল উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও চলমান প্রোগ্রামগুলোর অ্যাক্রিডিট করার সুপারিশ করা হয়েছে। উপাচার্য,্ উপ-উপাচার্য ও ট্রেজারার নিয়োগের ক্ষেত্রে একাডেমিক এক্সিলেন্স, প্রাশসনিক দক্ষতা ও নৈতিক মূল্যবোধের ওপর গুরুত্ব দিয়ে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ইউজিসির মতামত গ্রহণ করতে পারে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত কলেজ ও মাদ্রাসায় মানসম্মত উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করতে একটি সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়নের সুপারিশ করা হয়েছে। ৭৩’অধ্যাদেশ /আইনের অধীনস্থ ছাড়া অন্য সকল পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তির আওতায় নিয়ে আসার সুপারিশ করা হয়েছে।
0Shares