বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে আবারও বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের শীর্ষ পছন্দের গন্তব্য হয়ে উঠেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বিগত এক বছরে বাংলাদেশ থেকে মার্কিন মুল্লুকে গিয়েছেন মোট ৮ হাজার ৫২৪ জন শিক্ষার্থী। এর আগে গত ২০২২ সালে উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ৮ হাজার ৬৬৫ জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী। বিদেশে উচ্চশিক্ষার গন্তব্য নিয়ে জাতিসংঘের শিক্ষা বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর ‘গ্লোবাল ফ্লো অব টারশিয়ারি-লেভেল স্টুডেন্টস’ শীর্ষক প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
সম্প্রতি প্রকাশিত ইউনেস্কোর প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন মোট ৫২ হাজার ৭৯৯ জন শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীরা যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও তাদের উচ্চশিক্ষার পছন্দের দেশের তালিকায় রেখেছে যুক্তরাজ্য, কানাডা, মালেশিয়া এবং জার্মানির মতো দেশগুলোকে। যথাক্রমে এসব দেশে পাড়ি জমিয়েছে মোট শিক্ষার্থীর অর্ধেকেরও বেশি শিক্ষার্থী। এর মধ্যে যুক্তরাজ্যে ৬ হাজার ৫৮৬ কানাডায় ৫ হাজার ৮৩৫, মালয়েশিয়ায় ৫ হাজার ৭১৪ এবং জার্মানিতে ৫ হাজার ৪৬ জন শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য বাংলাদেশ ছেড়েছেন।
মূলত উন্নত দেশগুলোর মানসম্মত শিক্ষা, শিক্ষা পরবর্তী চাকরির বাজারে সহজে প্রবেশের সুযোগ এবং উন্নত জীবন ব্যবস্থার কারণে শিক্ষার্থীরা বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলোর উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যেহেতু স্কলারশিপসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের বেশি সুযোগ-সুবিধা দেবার চেষ্টা করছে তাই দেশটির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রতিনিয়ত বাড়ছে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের সংখ্যা।
এছাড়াও বাংলাদেশ থেকে অস্ট্রেলিয়ায় ৪ হাজার ৯৮৭, জাপানে ২ হাজার ৮২, প্রতিবেশী দেশ ভারতে ২ হাজার ৬০৬, কোরিয়া প্রজাতন্ত্রে ১ হাজার ২০২ এবং ১ হাজার ১৯০ জন শিক্ষার্থী সৌদি আরবে উচ্চশিক্ষার জন্য গিয়েছেন। এর আগে বিগত ২০২২ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য বাংলাদেশ ছাড়েন ৪৯ হাজার ১৫১ জন শিক্ষার্থী। যা তার আগের বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে ছিল ৪৪ হাজার ৩৩৮ জন।
দেশের শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের মতে, বিদেশে বাংলাদেশের তুলনায় ভালো মানের শিক্ষার সুযোগ শিক্ষার্থীদের দেশ ছাড়তে উদ্বুদ্ধ করছে। এছাড়াও উচ্চশিক্ষায় বিভিন্ন ধরনের বৃত্তিসহ নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা শিক্ষার্থীদের আগ্রহী করছে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। তাদের মতে, দেশের উচ্চশিক্ষালয়গুলো মান বৃদ্ধি এবং দেশে তরুণদের কাজের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে থামানো যেতে পারে মেধাবীদের বিদেশ যাত্রা।
এছাড়াও বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমিয়েছেন ফিনল্যান্ড, তুর্কিয়ে, সুইডেন, কাতার, নরওয়ে, ইতালিসহ ইউরোপ, এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। শিক্ষার্থীদের পছন্দের তালিকায় ছিল রাশিয়ান ফেড়ারেশনের দেশগুলোও। তবে বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে কম শিক্ষার্থী গিয়েছে গ্রিস, ব্রাজিল, জর্ডান, রোমানিয়া এবং আর্মেনিয়ায়। বিগত বছর এসব দেশে যাওয়া বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছাড়াতে পারেনি অর্ধশত হিসেবের ঘর।
হিসেব বলছে, প্রতিবছরই ক্রমান্বয়ে বাড়ছে বাংলাদেশ বিদেশে উচ্চশিক্ষা যাত্রীর সংখ্যা। তবে এ সংখ্যা প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান এবং নেপালের তুলনায় সংখ্যার বিচারে এখনও অনেক কম। অন্যদিকে দেশের শিক্ষাবিদরা বলছেন, শিক্ষার্থীরা বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য যাচ্ছে এবং উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছে এটি আপাত অর্থে ইতিবাচক বার্তা দিচ্ছে। কিন্তু এদের মধ্যে অধিকাংশ শিক্ষার্থীর দেশে ফেরত না আসা অথবা দেশে তাদের জন্য ভালো কোনো সুযোগ সৃষ্টি করতে না পারা ভবিষ্যতকে হুমকির দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের বিদেশে উচ্চশিক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস কথা বলে বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিয়ে কাজ করে এমন দুটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সাথে। বিইএসআই স্টাডি কনসালটেন্সির সিনিয়র অ্যাডমিশন অফিসার (আন্তর্জাতিক) মো. ইকবাল হোসেন এবং পিএফইসি গ্লোবালের কর্মকর্তা শাকিলা কামালের মতে, বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাংলাদেশ থেকে শিক্ষার্থী গ্রহণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের স্কলারশিপ দিয়ে থাকে। এছাড়াও অনেকেই স্কলারশিপ ছাড়াই দেশের বাইরে পড়াশোনা করতে যান। আর মোটামুটি সব শিক্ষার্থীরই আগ্রহের দেশ থাকে আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া কিংবা ইউরোপের দেশগুলো।
সাম্প্রতিককালে বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিয়ে মানুষের আগ্রহ এবং সচেতনতা বাড়ছে। ফলে আমাদের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার পাশাপাশি সহশিক্ষা-ক্রমিক কার্যক্রমেও অংশগ্রহণ করছে। যা তাদের বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য সহায়তা করছে। এছাড়াও পড়াশোনার পাশাপাশি কর্মের সুযোগ এবং চাকরিতে সহজে প্রবেশ ও উন্নত জীবনের আশাই শিক্ষার্থীদের বিদেশমুখী করছে—মনে করেন শাকিলা কামাল ও মো. ইকবাল হোসেন।
এ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক ড. এস এম হাফিজুর রহমান মনে করেন দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ার কারণে শিক্ষার্থীরা বিদেশ মুখী হচ্ছে। আর যুক্তরাষ্ট্রে বেশি সুযোগ-সুবিধা থাকার কারণেই দেশটি শিক্ষার্থীদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে। তার মতে, সহজে চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ এবং উন্নত জীবনব্যবস্থা একটি প্রভাবক শিক্ষার্থীদেরগামী করার ক্ষেত্রে।
দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মানবৃদ্ধি করে শিক্ষার্থীদের বিদেশে শিক্ষা গ্রহণের প্রবণতা রোধ করা যায় বলে মনে করেন এই শিক্ষাবিদ। তিনি বলেন, দেশের অনেক শিক্ষার্থীই বিদেশে শিক্ষার জন্য গেলেও শিক্ষা পরবর্তী সময়ে সেসব দেশে স্থায়ী হয়ে যান এবং তারা আর দেশে ফেরত আসতে চান না। এটি থামানো এখনই আমাদের থামানো উচিত বলেও মনে করেন তিনি। সেজন্য ইউজিসিসহ অন্যান্য তদারক সংস্থাসহ সংশ্লিষ্টদের কাজ করার পরামর্শ এই শিক্ষাবিদের।
অন্যদিকে দেশের উচ্চশিক্ষার তদারক সংস্থা বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের পরিচালক মো. ওমর ফারুখ বলেন, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যদের ইতঃপূর্বেই নির্দেশনা দিয়েছি আন্তর্জাতিক কারিকুলামের সাথে সমন্বয় করে সিলেবাস তৈরি করার জন্য। এ বিষয়গুলো আমরা নিয়মিত মনিটরিং করছি। শিক্ষার্থীদের যেন দেশীয় প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী করা যায় তার জন্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মানোন্নয়নে আমরা কাজ করছি।
আপনার মতামত লিখুন :