জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘অন ক্যাম্পাস’ অনার্স কোর্স বন্ধ হতে পারে


Shikkha Songbad প্রকাশের সময় : ফেব্রুয়ারি ১, ২০২৪, ৫:১৬ অপরাহ্ণ /
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘অন ক্যাম্পাস’ অনার্স কোর্স বন্ধ হতে পারে
0Shares

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সঙ্গে কোনো আলোচনা ছাড়াই গত বছর প্রথমবারের মতো তাদের মূল ক্যাম্পাসে স্নাতক (সম্মান) প্রোগ্রাম চালু করেছিল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। ‘অন-ক্যাম্পাস অনার্স’ নামে পরিচিত এই কোর্স চালুর ক্ষেত্রে আইন মানা হয়নি বলে ইউজিসির মূল্যায়ন। সে কারণে এই কোর্সে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপ চাওয়া হয়েছে। এর ফলে অন ক্যাম্পাস অনার্স কোর্স বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী এই প্রোগ্রামে বিধিনিষেধ আরোপের এখতিয়ার ইউজিসির নেই। অবশ্য সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইউজিসির আবেদনে সাড়া দিয়ে রাষ্ট্রপতি পদক্ষেপ নিলে তাতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ভঙ্গের বিষয়টি প্রমাণিত হবে। ফলে অন ক্যাম্পাস অনার্স কোর্স বন্ধ হওয়ার আশঙ্কাই বেশি।

জানা গেছে, গত বছরের ২০ জুলাই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গাজীপুরের মূল ক্যাম্পাসে ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে চার বছরমেয়াদি প্রথম বর্ষ স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে ভর্তির জন্য অনলাইনে আবেদনের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। বিজ্ঞপ্তিতে এলএলবি, বিবিএ, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট ও নিউট্রিশন অ্যান্ড ফুড সায়েন্স এ চারটি বিষয়ে ভর্তির জন্য ৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আবেদন চাওয়া হয়। বিষয়টি দৃষ্টিগোচর হওয়ার পর গত ১৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাসে অন ক্যাম্পাস অনার্স প্রোগ্রামে শিক্ষার্থী ভর্তির কার্যক্রম স্থগিত রাখার নির্দেশ দেয় ইউজিসি। একই সঙ্গে অন ক্যাম্পাস স্নাতক প্রোগ্রামে শিক্ষার্থী ভর্তির উদ্যোগ কেন নেওয়া হয়েছে সে বিষয়ে পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে ব্যাখ্যা চাওয়া হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে।

পরদিনই কমিশনের চিঠির জবাব দেয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। চিঠিতে বলা হয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন ১৯৯২-এর ৩ ধারায় এই আইনের প্রাধান্য সম্পর্কে বর্ণিত রয়েছে। এ ছাড়া ৬(খ), ৬(গ), ২৯, ২৯ (১)(ক) ও ৪১(১) ধারা অনুযায়ী অন ক্যাম্পাস অনার্স কোর্স চালু করা আইনের ব্যত্যয় নয়।

২৫ সেপ্টেম্বর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে ফের চিঠি দেয় ইউজিসি। এই চিঠিতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠানো জবাব কেন সঠিক নয়, তার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। কমিশনের চিঠিতে বলা হয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ৪৪(ক) ও ৫(১)(ক) ধারার ব্যত্যয় ঘটিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এমনকি ইউজিসির পূর্বানুমতি না নিয়ে মূল ক্যাম্পাসে স্নাতক প্রোগ্রাম চালু করার জন্য যে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে, তা আইন এবং এখতিয়ারবহির্ভূত।

পরদিন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইউজিসির চিঠির বিষয়ে ব্যাখ্যা দেয়। সেখানে বলা হয়—আইন বিষয়ে স্নাতক কোর্স পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের পূর্বানুমোদনের বিষয়টি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

৩ অক্টোবর ইউজিসি ফের চিঠি দেয়। সেখানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ক্ষমতা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন আদেশ সাপেক্ষে প্রযোজ্য হবে বলে কমিশন ফের স্মরণ করিয়ে দেয়।

৫ অক্টোবর কমিশনের চিঠির জবাব দিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় লিখে- ইউজিসির এখতিয়ার অবমাননার বিষয়টি যথাযথ নয়। চিঠিতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ইউজিসি ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটি যৌথসভা হতে পারে বলে আলোচনার আহ্বান জানানো হয়। তার পরিপ্রেক্ষিতে ১৭ অক্টোবর আরেক চিঠিতে ইউজিসি জানায়, স্নাতক প্রোগ্রামে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থী ভর্তির বিষয়ে কমিশনের আগের চিঠির সিদ্ধান্ত অপরিবর্তিত থাকবে। তবে যৌথ সভায় অংশগ্রহণের জন্য তিন থেকে পাঁচ কর্মকর্তার নামের তালিকা কমিশনে প্রেরণ করার জন্য বলা হয়। ৯ নভেম্বর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় পাঁচজন কর্মকর্তাকে মনোনয়ন দিয়ে আরেকটি চিঠি দেয়। তবে এর আগেই অন ক্যাম্পাস অনার্স কোর্সে ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ হয়ে যায়। এসব প্রোগ্রামে ভর্তি ফি নেওয়া হয়েছে ৫ হাজার ৩৫ টাকা। সে কারণে ইউজিসি বলেছে, ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ফেলায় প্রাসঙ্গিকতা না থাকায় সভাটি আর আহ্বান করা হয়নি।

সবশেষ গত ২৫ জানুয়ারি ইউজিসি থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বক্তব্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রণীত বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন আদেশ এবং ওই আদেশে প্রদত্ত কমিশনের এখতিয়ার ইচ্ছাকৃতভাবে অবমাননার শামিল। কমিশনের নির্দেশনা অমান্য করে মূল ক্যাম্পাসে স্নাতক প্রোগ্রামে এরই মধ্যে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়েছে এবং ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষেও শিক্ষার্থী ভর্তির পরিকল্পনা করা হয়েছে, যা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন ও সংবিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এই ধারাবাহিকতায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হলে ভবিষ্যতে শিক্ষার্থীরা আইনি জটিলতার শিকার, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কষ্টের কারণসহ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আইনগত উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। তাই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাসে স্নাতক প্রোগ্রামে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের আচার্য তথা রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপ কামনা করে কমিশন।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. মশিউর রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘ইউজিসি অন ক্যাম্পার্স কোর্স নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে। এর জবাব অনেক আগেই পাঠানো হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘গত বছর চারটি বিষয়ে অন ক্যাম্পাস অনার্স কোর্স চালু করা হয়। পরবর্তী বছরেও বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার চিন্তা আছে। সেটি আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে সরকার না চাইলে করা হবে না।’

ইউজিসির এক সদস্য বলেন, ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী অন ক্যাম্পাস অনার্স কোর্স চালু করার নিয়ম নেই। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী তাদের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ইউজিসির সঙ্গে আলোচনার দরকার হয়। কিন্তু তারা সেটি কখনো করেনি। এখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ৩ ধারা নিয়ে ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছে।’

বাংলাদেশ অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মেজবাহ উদ্দিন বলেন, ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম কাজ হওয়া উচিত ছিল কলেজগুলোতে গুণগত ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা। আমার ধারণা, সেই কাজটি এখনো যথাযথভাবে হয়নি। কলেজগুলোতে উচ্চ শিক্ষিত ও কাঙ্ক্ষিত যোগ্যতার শিক্ষক নেই। শিক্ষকের সংকটও রয়েছে। এই সমস্যা দিনের পর দিন চলে আসছে। কেন সেটি নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না তা বোধগম্য নয়।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক কালবেলাকে বলেন, ‘কলেজগুলোকে পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে। কিন্তু সেখানেও শিক্ষার মান নিয়ে বিভিন্ন সময় সমালোচনা হয়েছে। এখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে অন-ক্যাম্পাস অনার্স চালু করেছে সেটি দেখা দরকার। কেন ইউজিসি আদেশের ব্যত্যয় ঘটছে, সেটিও দেখা দরকার।’

যোগাযোগ করা হলে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, ‘ইউজিসির চিঠির বিষয়ে এখনো কিছু জানি না। এ বিষয়ে বিস্তারিত জেনে দ্রুতই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

0Shares